স্মার্ট ডিভাইসের ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন আপনার শিশুকে
আমরা জানি শিশুদের জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি তথা মোবাইল ডিভাইস বেশ ক্ষতিকর, তবে প্রযুক্তি নির্ভর এই যুগে আমরা চাইলেই সে সমস্ত প্রযুক্তি বাদ দিতে পারব না। কারণ এখন আমরা প্রযুক্তির উপর ব্যাপক ভাবে নির্ভরশীল। আবার আমরা শিশুদেরকেও ক্ষতির দিকে ঠেলে দিতে পারি না৷ তো শিশুদেরকে কিভাবে ডিজিটাল ডিভাইস বা প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখা যায় এবং প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যায় এটা নিয়েই এই লেখনী।
এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করার চেষ্টা করব এমন ১০ টি টিপস নিয়ে, যেগুলো আপনার শিশুর স্মার্ট ডিভাইসের আসক্তি কিছুটা হলেও কমাতে পারবে এবং ভবিষ্যৎ ক্ষতির হাত থেকে আপনার শিশুকে বাচাতে পারবে।
১. আপনার নিজের স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করুন
মানুষ মূলত তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং এই প্রক্রিয়া শুরু হয় তার জন্মের পর থেকে। সুতরাং আপনার সন্তান যা দেখবে তাই শিখবে। আপনি যখন Netflix এ দীর্ঘ সময় ধরে আপনার পছন্দের সিরিজটি দেখছেন, তখন অবশ্যই মাথায় রাখুন আপনি আপনার বাচ্চাদের জন্য একটি উদাহরণ স্থাপন করছেন।
আজকে বাসায় সব সময় টিভি অন করে রাখছেন, যেকোনো সময় ফোনে স্ক্রুল করছেন এর মানে কিছু দিন পরেই সেটা আপনার সন্তানের মধ্যে দেখতে পাবেন। সুতরাং আপনার সন্তানের অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে আপনার অভ্যাসেরও পরিবর্তন জরুরি।
শিশুরা স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারের সময় যেন অপ্রত্যাশিত কন্টেন্ট বা ভিডিও এর সাজেশন না পায় সেটাও আপনাকেই নিশ্চিত করতে হবে। আমরা বাসায় যখন একই ওয়াইফাই সবাই ব্যবহার করি তখন আমাদের নির্দিষ্ট একটা আইপি থাকে, ইউটিউব সহ অন্য বিভিন্ন স্ট্রিমিং সার্ভিসের নিয়ম মতে আপনি যে কন্টেন্ট গুলো দেখবেন একই আইপির অধীনে অন্য ডিভাইস গুলোকেও একই কন্টেন্ট রিকোমেন্ড করা হবে। তাই আপনি এমন কন্টেন্ট দেখা থেকে বিরত থাকুন যা আপনার শিশুর জন্য নিরাপদ নয়।
২. প্রযুক্তি সম্পর্কে জানুন, নিজের প্রযুক্তি জ্ঞান আরও সমৃদ্ধ করুন
আমরা দেখতে পাচ্ছি বর্তমান সময়ে প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় শিশুরা প্রযুক্তি সম্পর্কে বেশি জানে। সুতরাং ২০২১ সালের একজন আদর্শ অভিভাবক হিসেবে আপনাকে সময়ের সাথে আপ -টু -ডেট থাকতে হবে। এর মুল কারণ হচ্ছে আপনি যখন প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিক গুলো জানতে পারবেন তখনই কেবল শিশুকে এই বিষয় গুলো সম্পর্কে সচেতন করতে পারবেন।
ধরুন আপনি নিজেই জানেন না কিভাবে সেইফ ভাবে ব্রাউজিং করতে হয় তাহলে আপনার সন্তানকে কিভাবে সেটা শেখাবেন। তাছাড়া আপনি যখন বিভিন্ন প্রযুক্তি এবং অ্যাপ সম্পর্কে জানবেন তখন সেগুলো শিশুর ব্যবহার কারা স্মার্টফোনে ইন্সটল করে তাদের অনলাইন নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারবেন। যেমন অনেক প্যারেন্টিং অ্যাপ রয়েছে যেগুলো ইন্সটল দিলে শিশুরা বিভিন্ন ভাইরাস, ম্যালওয়ার, এডাল্ট কন্টেন্ট থেকে নিরাপদে থাকবে। তাই আপনি আগে টেকনোলজি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করুন এবং শিশুদের এর ক্ষতি থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করুন।
৩. প্যারেন্টাল কন্ট্রোল অ্যাপ বা মেইল ব্যবহার করুন
অনলাইনে আপনার শিশুকে নিরাপদ রাখতে এবং তাদের সকল ধরণের অবাঞ্ছিত কন্টেন্ট থেকে দূরে রাখতে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল অ্যাপ গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আপনি সেই সমস্ত অ্যাপ ব্যবহার করে সহজেই স্মার্টফোন এবং টিভির কন্টেন্টে ফিল্টার করে দিতে পারবেন যা সকল এডাল্ট কন্টেন্ট ব্লক করে দেবে।
তাছাড়া প্যারেন্টাল কন্ট্রোল অ্যাপ গুলো দিয়ে শিশুর স্মার্টফোন ইউজের সময়ও নির্ধারণ করে দিতে পারবেন। শিশুরা কখন কখন ফোন ইউজ করতে পারবে কোন কোন অ্যাপে এক্সেস পাবে সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে অ্যাপ গুলোতে।
শিশুর হাতে ফোন দিলে সেটিতে আপনি প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ইমেইলও ব্যবহার করতে পারেন৷ গুগলে প্যারেন্টাল ইমেইল নিয়ে ফ্রি একটি সার্ভিস রয়েছে। যখন জিমেইল একাউন্ট খুলতে যাবেন তখন ইউজারের বয়স ১৩ বছরের নিচে দিলে গুগলই প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ফিচারটি সাজেস্ট করবে। এই ইমেইলের মাধ্যমেও শিশুর ইন্টারনেট তথা স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারে নজরদারি করতে পারবেন।
৪. বিভিন্ন অ্যাপের চাইল্ড ভার্সন ব্যবহার করুন
স্মার্ট ডিভাইসে শিশুদের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রায় প্রতিটি কোম্পানি চাইল্ড ভার্সন নিয়ে কাজ করছে। ইউটিউবের একটি চাইল্ড ভার্সন রয়েছে যদিও বাংলাদেশে এটা এভেইলেবল নয়। একই সাথে রয়েছে ফেসবুক এবং মেসেঞ্জারেরও চাইল্ড ভার্সন৷ আপনার শিশুর নিরাপত্তার জন্য এই অ্যাপ গুলোর চাইল্ড ভার্সন এনেভল করে দিতে পারেন এতে করে তারা শিশুদের উপযোগী কন্টেন্ট সরবারহ করবে।
ফেসবুক বা মেসেঞ্জারে চাইল্ড ভার্সন ব্যবহার করলে অভিভাবকেরা জানতে পারবে তারা সেখানে কি করছে। শিশুকে কেউ মেসেজ দিলে সেটা তারা জানতে পারবে এবং কেবল পারমিশন পেলেই শিশু নির্দিষ্ট ব্যক্তির সাথে চ্যাট করতে পারবে।
৫. শিশুর সাথে আপনিও অংশ নিন
শিশুরা যখন ইন্টারনেট বা অন্যান্য স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করবে তখন তার সাথে আপনিও অংশ নিন। যেমন তাদের সাথে শিক্ষা মূলক বিভিন্ন ভিডিও দেখুন ভাল ভাল চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করে দিন। যেসব কন্টেন্ট দেখলে তারা নতুন কিছু শিখতে ও জানতে চাইবে সেসব কন্টেন্টে আগ্রহী করে তুলুন।
একটা নির্দিষ্ট বয়সের আগ পর্যন্ত আপনি আপনার সন্তানের সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্ক গুলোর পাসওয়ার্ড জানতে চাইতে পারেন৷ আপনার অবর্তমানে আপনার সন্তান কোন বুলিং এর শিকার হচ্ছে কিনা, কোন ভুল কমিউনিটিতে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে কিনা সেটা আপনাকে জানতে হবে। তাকে এই ব্যাপার গুলোতে সচেতন করতে হবে।
৬. সৃজনশীল কাজে উৎসাহিত করুন
প্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে শিশুদেরকে স্মার্টফোন বা ডিভাইস থেকে দূরে রাখা সহজ না হলেও, তার অভ্যাস আগ্রহ পরিবর্তন করে অনেকটাই তাকে নিরাপদে রাখা সম্ভব। তাকে বই পড়তে বলুন আর এজন্য অবশ্যই নিজে বই পড়ে তাকে উৎসাহ দিন। বাইরে খেলতে নিয়ে যান, প্রতিদিন খেলার অভ্যাস গড়ে তুলুন, তার আগ্রহ বুঝে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ করান সেটা হতে পারে ক্রাফটিং, আর্ট, সাইন্স এক্সপেরিমেন্টিং ইত্যাদি৷
৭. বাসায় টেকনোলজি ফ্রি জোন তৈরি করুন
শিশুদেরকে প্রযুক্তি থেকে কিছুটা দূরে রাখতে আপনি বাসায় একটি টেকনোলজি ফ্রি জোন তৈরি করতে পারেন। সেটা হতে পারে ডাইনিং রুম অথবা বাসায় ছাদ। যখন একসাথে খাওয়া দাওয়া করবেন তখন কেউ স্মার্টফোন বা কোন ডিভাইস ব্যবহার করবে না, এতে করে পরিবারের সদস্যাদের মধ্যে ভাল একটি মেলবন্ধন তৈরি হবে৷
বাসার ছাদ বা বেলকনিতে এমন একটি টেকনোলজি ফ্রি জোন তৈরি করতে পারেন যেখানে আপনারা অবশর সময় কাটাবেন বা বিকেলে এক সাথে আলাপ আলোচনা করবেন। যদি সম্ভব হয় বাসায় ছোট কাট লাইব্রেরী রাখতে পারেন। নিজেও বই পড়বেন এবং শিশুদেরও উৎসাহিত করবেন।
টেকনোলজি ফ্রি জোনের মত দিনের একটা সময় বেছে নিতে পারেন যখন কেউ তাদের ডিভাইস গুলো ব্যবহার করবে না বা ডিভাইস থেকে দূরে থাকবে। এমন একটা সময় হতে পারে ডিনারের সময়, যখন সবাই এই সকল ডিভাইস থেকে দূরে থাকবে । অথবা ঘুমানোর আগেও এমন একটা সময় নির্ধারণ করতে পারেন। অনেক রিসার্চ থেকে উঠে এসেছে ঘুমানোর আগে ডিভাইস ব্যবহারের ফলে ঘুম আসতে সময় বেশি লাগে। তাই নির্দিষ্ট কিছু সময়ে ফোন ব্যবহার না করার পরামর্শ দিন আপনার শিশুকে।
৮. ক্ষতিকর দিক গুলো তাদের কাছে তুলে ধরুন
আপনি যখন টেকনোলজি ব্যবহার নিয়ে উপরে বর্ণিত পদক্ষেপ গুলো গ্রহণ করবেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই শিশুরা এই বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইবে, তারা আপনাকে প্রশ্ন করার আগে আপনিই তাদের সামনে বিষয় গুলো তুলে ধরুন।
আপনার শিশুর বয়স অনুযায়ী তাকে সচেতন করুন। বেশিক্ষণ ডিভাইস ব্যবহারে শারীরিক ও মানসিক যে নেতিবাচক দিক গুলো রয়েছে সেগুলো তাদের জানান। ভিডিও গেম, সিনেমা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং কেন ক্ষতিকর সেটা তাদের ভাল করে বুঝানোর চেষ্টা করুন। আপনি একা না বরং অন্য সদস্যরাও যেন তাদের এ ব্যাপার গুলোতে সচেতন করে সেটা নিশ্চিত করুন।
৯. স্মার্টফোন বা ডিভাইস ব্যবহারের সময় বেধে দিন
আপনার শিশুর যদি স্মার্টফোন, গেমিং কনসোল বা কম্পিউটার থাকে তাহলে সেটা ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট সময় বেধে দিন। যেমন দিনের নির্দিষ্ট সময়, ৪ ঘণ্টার বেশি ফোন ব্যবহার করা যাবে না, ঘুমানোর আগে ফোন ব্যবহার করা যাবে না৷ শিশুরা যেন স্মার্টফোনের দিকে আসক্ত না হয় সেটা আপনার প্রথম লক্ষ্য থাকবে তবে যদি আসক্ত হয়ে যায় সেক্ষেত্রে টাইম লিমিট করা জরুরি ।
ডিভাইস ব্যবহারের টাইম নির্দিষ্ট করতে অবশ্যই দিনের এমন সময় গুলো বেছে নিন যখন তাদের পড়াশুনায় মনোযোগ তুলনামূলক কম থাকে।
১০. বেড-রুম ডিজিটাল ডিভাইস মুক্ত রাখুন
আপনার শিশুরা ঘুমানোর আগে কি করছে এটা যদি আপনি না দেখতে পারেন তাহলে অবশ্যই নিশ্চিত করুন তার বেডরুমে যেন কোন স্মার্টডিভাইস যেমন, গেমিং কনসোল, টিভি, কম্পিউটার না থাকে। উল্লেখিত ডিভাইস গুলো ব্যবহার করা না হলেও এগুলো শিশুদের ঘুমকে প্রভাবিত করতে পারে বলেই গবেষকেরা মত দিয়েছেন।
তাই বেডরুমে যেন স্মার্ট ডিভাইস না থাকে সেটা নিশ্চিত করুন।
শেষ কথা
ছোট বেলা থেকেই শিশুদেরকে স্মার্টফোন বা বিভিন্ন স্মার্ট ডিভাইস থেকে দূরে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ, কিন্তু আপনার যদি মনে হয় দেরি করে ফেলেছেন তাহলে যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন। শিশুদেরকে বাবা-মা উভয়ই বেশি করে সময় দিন তাদের সাথে ফ্রি ও সহজ হবার চেষ্টা করুন।