Teenage healthপ্যারেন্টিংস্বাস্থ্য

শিশু বিকাশে প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট এর বিরূপ প্রভাব

ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তি আমাদের জীবন ধারায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এটা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না। নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট পরিবর্তন করে দিচ্ছে আমাদের প্রতিদিনের জীবন ধারাকে। এখন আমাদের লাইফ স্টাইল যেমন সেটা পাঁচ বছর আগেও ছিল না। পাঁচ বছর তো অনেক সময়, গত তিন বছরেই আমরা অনেক কিছুর পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি।

২০২০ সালের করোনা মহামারির পর থেকে আমরা দেখেছি ব্যাপক পরিবর্তন। ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তি পুরো জীবনধারা আমাদের বদলে দিয়েছে৷ ইন্টারনেটের ব্যবহার যেমন বেড়েছে তেমনি তৈরি হয়েছে এর উপর নির্ভরতা। খাদ্যাভ্যাস, কেনাকাটা, চাকরি এমনকি পড়াশোনার ধরণও পাল্টে গেছে। ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তির এই রূপটি সবচেয়ে ক্ষতিকর শিশুদের জন্য। এর আগেও শিশুদের ইন্টারনেট এবং ডিভাইস থেকে দূরে রাখা সম্ভব হতো, কিন্তু যখন পড়াশুনাই তাদের ইন্টারনেট নির্ভর তখন আপনি চাইলেও ইন্টারনেট থেকে তাদের দূরে রাখতে পারবেন না।

শিশু বিকাশে ইন্টারনেটের প্রভাব

আমরা জানি ইন্টারনেট এক বিশাল তথ্য ভাণ্ডার এবং একই সাথে এখানে নেই কোন সিকিউরিটি এবং বিশ্বাসযোগ্যতা। সত্য মিথ্যা সহ অনেক ধরনের তথ্যে পরিপূর্ণ এই ইন্টারনেট ব্যবস্থা। কোন তথ্য গ্রহণ করা উচিৎ কোন তথ্য বর্জন করা উচিৎ সেটা নিয়ে নেই কোন দিক নির্দেশনা। আর এই সব কিছু নিয়ে বিশ্বের মনোবিজ্ঞানীরা চিন্তিত, তারা শঙ্কায় আছে ইন্টারনেট শিশুদের সামাজিক, মানসিক এবং শারীরিক বিকাশকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করতে পারে৷

সামাজিক বিকাশ

ব্যাপক ইন্টারনেট ব্যবহার শিশুদের সামাজিক বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে এবং দৃঢ় করতে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। ইমোশনাল হেলদ ও মেন্টাল হেলদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন রিসার্চ বলছে যে শিশুরা ইন্টারনেটে বেশি আসক্ত তারা মেন্টাল হেলদ ইস্যু বেশি ফেস করছে। তাদের মধ্যে মানসিক এবং আচরণগত সমস্যা বেশি।

শিশুর জন্মের পর থেকে ছয় বছর, এই সময়টা তাদের মানসিক এবং শারীরিক বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় তারা চারপাশের সব কিছু দেখবে, জানবে, পরিবারের প্রতি নির্ভরশীল হবে, আশেপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষা নেবে এবং এটি একটি ন্যাচারাল বিষয়। কিন্তু এই সময় যদি তার অধিকাংশ সময় কেটে যায় ফোনে বা ইন্টারনেটে তাহলে বুঝতেই পারছেন তারা প্রতিনিয়ত অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ফোনে বা ইন্টারনেটে অধিক সময় ব্যয় করায় তারা বিভিন্ন সোশ্যাল স্কিল শিখতে পারছে না৷ স্বাভাবিক ভাবেই আশেপাশের মানুষ, প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে শিখতে পারছে না। পরিবার থেকে সে সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হলেও সঠিক চর্চার অভাবে তাদের মধ্যে সেই অভ্যাস গড়ে উঠছে না।

ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে শিশুরাও এখানে বড়দের মত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা শিখছে, নিজেদের ভাল মুহূর্ত সোশ্যাল মিডিয়া শেয়ার করছে এবং অন্যরা এতে বঞ্চিত হওয়াতে বিষণ্ণতা দেখা দিচ্ছে। ধরুন আপনার পাশের বাসার প্রতিবেশী দূরে কোথাও ঘুরতে গিয়ে ছবি শেয়ার করল এটা দেখে আপনার সন্তানদের মধ্যেও ইচ্ছা বা আগ্রহ দেখা দেবে। আর সেটা না পেলে তার মধ্যে হতাশা কাজ করবে।

সুস্থ মানসিক বিকাশ

অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশও ব্যাহত হচ্ছে। আগে আমরা আলোচনা করেছি ইন্টারনেট কীভাবে শিশুদের হতাশার কারণ। ইন্টারনেট এমন এক জায়গা যেখানে কোন রুলস এবং রেগুলেশন নেই। যেকেউ চাইলে যেকোনো কিছু দেখতে পারে। শিশুদের জন্য রয়েছে ক্ষতিকর অনেক কিছু। আপনার অজান্তেই শিশুরা চলে যেতে পারে পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইটে, অনলাইন ক্যাসিনো ওয়েবসাইটে, হটাৎ করে তাদের সামনে চলে আসতে পারে বীভৎস কোন ছবি বা ভিডিও। আর এভাবে ইন্টারনেট আপনার শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।

বিভিন্ন গবেষণা বলছে একটা নির্দিষ্ট বয়সের আগে পর্নোগ্রাফির মত বিষয় শিশুদের সামনে চলে আসলে সেটা তাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারে। বিভিন্ন সোর্স বলছে শিশুদের যৌন শিক্ষা একটা নির্দিষ্ট বয়স পরেই দেয়া উচিৎ। বেশির ভাগে সোর্স সাজেস্ট করে শিশুদের যৌন শিক্ষার উপযুক্ত বয়স হতে পারে আট বছর বয়স বা তারও পরে। এটা অবশ্য দেশ, জাতি, সংস্কৃতি অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে।

শারীরিক বিকাশ

ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি শিশুদের শারীরিক বিকাশকে দারুণ ভাবে ব্যহত করতে পারে এটা এর আগেও অনেক বার বলা হয়েছে এবং এটা বারবার বলা উচিৎ। পড়াশুনার জন্য হোক বা অন্য কাজে হোক, যে কারণেই আপনি শিশুদের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে দেবেন, সেটা আপনার শিশুর ক্ষতি করবেই। স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারে আপনার শিশুর বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাই দেখা দিতে পারে।

স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেটের মত ডিভাইসের আলো কতটা ক্ষতিকর এটা আমরা জানি। দীর্ঘসময় এই সব ডিভাইসে তাকিয়ে থাকার ফলে শিশুদের চোখে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। যখন থেকে চোখের বিকাশ শুরু হয় তখন থেকে এই ধরনের লাইট তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির দিকে ধাবিত করতে পারে।

স্মার্টফোন বা স্মার্ট ডিভাইস শিশুদের অঙ্গবিন্যাসেও সমস্যা তৈরি করতে পারে। দীর্ঘসময় এক পজিশনে ফোন ব্যবহারে দেহের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হওয়ার সাথে সাথে শিশুরা ভুল অঙ্গ ভঙ্গিতেও অভ্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। গবেষণা বলছে যে শিশুরা দিনে আধা ঘণ্টা থেকে তিন ঘণ্টা ফোন ব্যবহার করে তাদের ওজন বেশি হওয়ার সম্ভাবনা বাকিদের তুলনায় ৫৩% বেশি।

ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তির যুগে আপনি চাইলেও এগুলোকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না তবে আপনি চাইলে সেটার ক্ষতিকর দিক অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারবেন। যথাযথ প্যারেন্টিং এবং ইন্টারনেট লিমিটের মাধ্যমে শিশুদেরকে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাচাতে পারবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button