সাইকোলজি

কিশোর আত্মহত্যা কি? কিভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে

কিশোর আত্মহত্যা কি? কিভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে?

কিশোর আত্মহত্যা বর্তমানে বাংলাদেশ তথা বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। আশা করছি কিশোর আত্মহত্যা কি এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। যখন কিশোর কিশোরী আত্মহত্যার মত ভয়াবহ কর্মকাণ্ড ঘটায় তখন তাকে কিশোর আত্মহত্যা বলে। এই ধরণের কাজ করার আগে তাদের মাথায় শুধু এই একটি বিষয়ই ঘুরাফেরা করে৷ হটাৎ করে যেকোনো ঘটনায় আবেগের বশে এই ধরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে যেকোনো কিশোর কিশোরী।

বর্তমান সময়ে পরিসংখ্যান দিচ্ছে আত্মহত্যা নিয়ে ভয়াবহ তথ্য। আমেরিকান একাডেমী অফ পেডিয়াট্রিক্স অনুসারে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুবকদের জন্য আত্মহত্যা মৃত্যুর তৃতীয় প্রচলিত কারণ। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত, তিন বছরে আত্মহত্যা করেছে ২৪ হাজার ৫৬৮ জন শিশু। যার বেশিরভাগই মেয়ে। আত্মহত্যাকারী মেয়ের সংখ্যা ১৩ হাজার ৩২৫ জন। এবার আসি বাংলাদেশে, ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছে, যাদের মধ্যে ৩৫% এর বয়স ৫ থেকে ১৯ বছর। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী জানা যায়,

  • মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা ৪ গুণ বেশি আত্মহত্যা করে
  • ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি আত্মহননের চেষ্টা করে
  • বিশ্বে কিশোর আত্মহত্যার অর্ধেক সংগঠিত হয় বন্ধুক দিয়ে

কিশোর আত্মহত্যার কারণ

কিশোর বয়সটা একটা ঝুঁকিপূর্ণ সময়। এই সময় মানুষ ধাবিত হতে পারে বিভিন্ন নিষিদ্ধ কাজে। শারীরিক, মানসিক বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় বলে এই সময় কিশোর কিশোরীদের মাঝে উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, হতাশা দেখা দেয়। এইসব উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, হতাশা যখন চরম আকার ধারণ করে তখনই অনেক তরুণ তরুণী সহ্য করতে না পেরে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে।

এমনিতেই সহজাত পরিবর্তনে তারা আনসেটেল কন্ডিশনে থাকে তার মধ্যে বাহ্যিক বিভিন্ন পরিবর্তন বা ঘটনা তাদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে যেমন,

  • পারিবারিক বিচ্ছেদ, বাবা মায়ের ডিভোর্স
  • ফ্রেন্ডশিপ পরিবর্তন, অথবা প্রেম সংক্রান্ত ঝামেলা
    প্রিয় কোন কিছু হারানো
  • বিভিন্ন ধরণের বুলিং

এই ধরণের ঘটনা গুলো ওভারকাম করা কিশোর কিশোরীদের কাছে কখনো এতটা কঠিন যে তারা আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন সমাধান খোজে পায় না।

কোন টিনেজাররা সুইসাইডের রিস্কে আছে

কিশোর কিশোরীরা যেকোনো বয়সে আত্মহত্যা প্রবণ হতে পারে , সুইসাইডের বিভিন্ন রিস্ক ফ্যাক্টর যেমন কালচার, বয়স, লিঙ্গ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পরে। তবে তারা আত্মহত্যা ঝুঁকিতে আছে,

  • যাদের একাধিক মানসিক সমস্যা রয়েছে এবং মাদকাসক্ত
  • যারা মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ
  • যারা সম্প্রতি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে, প্রিয় কোন কিছু হারানো, মা বাবা মৃত্যু
  • পরিবারে এর আগের আত্মহত্যার মত ঘটনা আছে যাদের
  • যারা পারিবারিক ভায়োলেন্স এর শিকার বা সেক্সুয়াল বা ইমোশনাল এবিউসের শিকার
  • যারা অতীতে কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে
  • কারাবাস
  • আত্মহত্যা নিয়ে বন্ধু মহল, সোশ্যাল মিডিয়া, পত্রপত্রিকায়, সিনেমায় মাত্রাতিরিক্ত চর্চা। এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করে যারা।

যেভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে কিনা

সুইসাইডের সাইন আর ডিপ্রেশনের সাইনের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। ডিপ্রেশন চরম আকার ধারণ করলেই সেটা আত্মহত্যার কারণে পরিণত হয়। যে লক্ষ্মণ গুলো দেখলে আপনি বুঝবেন আপনার সন্তান খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং তার যথাযথ ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন,

খাবার দাবার এবং ঘুমে অস্বাভাবিক পরিবর্তন

মাত্রাতিরিক্ত ডিপ্রেশনে কিশোর কিশোরীর ঘুমে পরিবর্তন আসতে পারে৷ রাতে ঘুম কমে যেতে পারে আবার অসময়ে ঘুম আসতে পারে৷ সারাদিন শুয়ে থাকা ডিপ্রেশনর লক্ষ্মণ। ডিপ্রেশনে খাবার দাবারেও পরিবর্তন আসতে পারে। ডিপ্রেশনে খাবার কমে যেতে পারে অথবা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েও যেতে পারে।

দৈনন্দিন কাজ কর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা

আপনার সন্তানের মধ্যে ডিপ্রেশনের লক্ষ্মণ হতে পারে আপনি খেয়াল করে দেখবেন, সে রেগুলার কাজ গুলোতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। হয়তো পড়াশুনায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে, সারাদিন অন্যমনস্ক হয়ে থাকছে ইত্যাদি৷ আগে যে কাজ গুলো করতে পছন্দ করতো সেই কাজ গুলো থেকে দূরে সড়ে যাওয়াও ডিপ্রেশনকে ইন্ডিকেট করে।

বন্ধু বান্ধব ও পরিবার থেকে দূরে থাকতে শুরু করা

যদি আপনি খেয়াল করেন আপনার ছেলে বা মেয়ে ইদানীং পরিবারে সময় দিচ্ছে না, আলাদা থাকছে এমনকি বন্ধুদের থেকেও দূরে থাকছে তখন বুঝবেন অবশ্যই সে মানসিক ভাবে চাপে আছে৷

এছাড়াও এলকোহল ও ড্রাগ আসক্ত হয়ে যাওয়া, মৃত্যু নিয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ বা উৎসাহ দেখানো, স্কুল বা পড়াশুনায় চরম অনীহা প্রকাশ, কথায় আত্মহত্যার কথা বলা, সোশাল মিডিয়াতে দীর্ঘ সময় ধরে ডিপ্রেশন রিলেটেড কন্টেন্ট শেয়ার দেয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখে বুঝতে পারবেন আপনার সন্তান মানসিক সমস্যার মধ্যে আছে।

এই ধরণের আচরণে কি ধরণের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে

যখন কোন কিশোর কিশোরীর মধ্যে এই ধরনের আচরণ লক্ষ্য করবেন তখন যত দ্রুত সম্ভব তার ট্রিটমেন্ট করুন। তবে বয়স, লক্ষ্মণ, কন্ডিশন অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট ভিন্ন হতে পারে। প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে পরিবারের পক্ষ থেকে। পরিবারে যে সবচেয়ে ক্লোজ তার উচিৎ রোগীর সাথে কথা বলা৷ তার সমস্যা জানার চেষ্টা করা এবং যুক্তিযুক্ত কোন সমাধান বের করা। যদি অবস্থা বেশি খারাপের দিকে যায় তাহলে দ্রুত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিন। হসপিটালে স্পেশাল কেয়ারেও রাখতে পারেন।

কিশোর আত্মহত্যা রোধের উপায়

আপনি যখন আপনার সন্তানের মধ্যে লক্ষণ গুলো দেখবেন তখন অবশ্যই নিচের পদক্ষেপ গুলো গ্রহণ করুন,

ঘর থেকে ওষুধ ও বন্দুক জাতীয় জিনিস পত্র লুকিয়ে রাখুন। তাদের সব সময় নজরে রাখুন ।আত্মহত্যা সম্পর্কে ইন্টারনেট, লাইব্রেরী থেকে আর্টিকেল পড়ুন নিজেকে আপডেট রাখুন। সন্তানকে একা থাকতে নিরুৎসাহিত করুন। সব সময় পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে থাকতে বলুন।

তাদের সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট গুলোর দিকে নজর রাখতে পারেন। সে কি শেয়ার দিচ্ছে এবং কারা কি ধরণের মন্তব্য করছে সেটি জানার চেষ্টা করুন। ভাল হয় যদি তাকে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে রাখতে পারেন। তাকে সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে পারেন। এই সময় আপনার সন্তানকে হেলদি লাইফ স্টাইলের দিকে উৎসাহিত করুন। তাকে ভাল পুষ্টিকর খাবার দিন, এক্সারসাইজ করতে বলুন, ঠিক মত ঘুমাতে বলুন।

এটা সব সময় ঘটে না তবে মাঝে মাঝে এমন হতেও পারে আন্টিডিপ্রেশন মেডিকেশনের প্রভাবে আপনার সন্তান আত্মহত্যা প্রবণ হয়ে যেতে পারে। আন্টিডিপ্রেশন মেডিকেশন ডিপ্রেশন কমাতেই সাহায্য করে তবে যদি ব্যতিক্রম কিছু লক্ষ্য করে তাহলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।

আপনার বন্ধুর মধ্যে যদি আত্মহত্যার লক্ষ্মণ দেখেন তাহলে,

  • বন্ধুকে সময় দিন তার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করুন
  • বন্ধুকে নিজ উদ্যোগে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখান
  • বন্ধুর পরিবারের লোকজনকে বিষয়টি জানান এবং সমাধানে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করুন।

আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তার পেছনে অনেক গুলো কারণ রয়েছে এর মধ্যে বাংলাদেশে কিশোর আত্মহত্যার অন্যতম কারণ বিভিন্ন পরীক্ষার রেজাল্ট। আশানুরূপ ফলাফল না করতে পেরে অনেকেই এই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় এর পেছনে বাবা মারা অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী। তারা রেজাল্টের পর সন্তানের পাশে না দাঁড়িয়ে কখনো সব চেয়ে বড় ভুলটা করে বসেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button