শিশুদের স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারে পাঁচটি ক্ষতিকর দিক
আমি, আপনি, আমরা সবাই আমাদের শিশুদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে হয়তো অনেক সচেতন। কিন্তু ঠিক কোন জায়গা গুলোতে সচেতনতা বাড়াতে হবে এই ব্যাপারে অধিকাংশ বাবা মা আজ উদাসীন। আপনি নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হয়তো রোজগার থেকে প্রতিনিয়ত কিছু কিছু জমাচ্ছেন, তাদের কোন স্কুলে পড়াবেন সে ব্যাপারে আগে থেকে খোজ নিচ্ছেন, বাসায় তার জন্য সুন্দর পরিপাটি একটি কক্ষ তৈরি করেছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, ২০২১ সালে এই প্রযুক্তির যুগে আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ এর জন্য শুধু মাত্র এই বিষয় গুলোতে নজর দিলেই হবে না? প্রযুক্তির এই যুগে সেরা বাবা/মা হতে আপনাকে পূর্বের তুলনায় হতে হবে আরও বেশি এডভান্স।
আমরা এই বিষয়টি সবাই জানি, মানুষ তার অভ্যাস এর দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হয় এবং সেই অভ্যাসটি গড়ে উঠে শিশুকাল থেকে। তো আপনি আপনাকে শিশুর ভবিষ্যৎ সুন্দর করতে চাইলে প্রথমেই তার অভ্যাস গুলোর দিকে নজর দিন। তাকে কখনোই এমন কাজে অভ্যস্ত করানো যাবে না যেটা তার জন্য ভাল না। এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে আপনাকে আজকে থেকেই কিছু বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
প্রযুক্তি এবং আজকের শিশু
বাচ্চা কান্না করছে, আপনার হাতে হয়তো সময় কম, কি করছেন ফোনে কার্টুন দেখতে দিচ্ছেন! আপনি হয়তো জানেন না, শর্ট-টার্মে এটা আপনাকে সাহায্য করলেও লং-টার্মে এর প্রভাব ভয়াবহ । আপনি ইতিমধ্যে এমন কাজ করলে এখনি হয়তো খেয়াল করে দেখবেন, আপনার শিশু ডিজিটাল ডিভাইসের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। শিশুকে খাওয়াতে গেলে ডিভাইসের দরকার হচ্ছে অথবা কান্না থামানোর একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিভাইস।
অনেক বাবা-মা ভাবেন, যেহেতু আমার ছেলে/মেয়ে এখনো অনেক ছোট সেহেতু ডিভাইস গুলো তেমন ক্ষতিকর নয়, যখন পড়ার বয়স হবে তখন ডিভাইস থেকে তাদের দূরে রাখব। কিন্তু জেনে রাখুন, আপনার সন্তানের বয়স যদি ৩ থেকে ৪ বছর হয় তাহলে এই ডিভাইস গুলো তাদের পড়াশুনার কোন ক্ষতি না করলেও তাদের মানসিক এবং শারীরিক ভাবে অসুস্থ তুলছে । চোখের বিভিন্ন সমস্যা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া সহ আরও অনেক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। একই সাথে আপনি এখন থেকে শিশুকে ডিভাইসে অভ্যস্ত করলে, চাইলেও পরবর্তীতে যখন তার পড়াশোনার সময় আসবে তখন সেগুলো বাদ দিতে পারবেন না।
বিষয় গুলো আরও গভীর ভাবে উপলব্ধি করার জন্য আজকের এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করব, শিশুদের স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারে ৫ টি নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে। আশা করছি সকল সকল বাবা-মা এই আর্টিকেল থেকে নতুন কিছু জানতে পারবেন।
১. সামাজিক এবং পারিবারিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা
বাচ্চারা যখন বেশি বেশি স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করবে তখন তারা স্বাভাবিক ভাবেই পরিবার এবং বন্ধুদের থেকে আলাদা হতে থাকবে। ইন-পারসন কথা বা ভাব বিনিময় থেকে অনলাইনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। আর এভাবে তারা সামাজিক বিভিন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে, কিভাবে কোথায় কি আচরণ করবে সেটা শিখবে না বা শিখতে চাইবে না।
আপনি খেয়াল করে দেখবেন, আপনি যখন ছোট ছিলেন তখন পারিবারিক কোন আলাপ আলোচনায় আপনি সবার সাথে বসে থাকতেন, সবার কথা শুনতেন। কিন্তু এখন শিশুরা কি করে? ফোন বা ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আপনি হয়তো তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন এই ভেবে, যে গুরুত্বপূর্ণ এই আলোচনায় সে বিরক্ত করছে না, কিন্তু এটা বুঝতে পারছেন না এই মুহূর্তে তার যে শিক্ষাটা পাবার কথা সেটা থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে।
তাছাড়া এটা প্রমাণিত এই প্রজন্মের শিশুদের অনলাইনে গেম খেলা, বিভিন্ন ওয়েবসাইটে এক্সেস নেয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় দেয়াতে বাবা মার সাথে তাদের বন্ধন দুর্বল হচ্ছে।
২. শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা
মাত্রাতিরিক্ত ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা শিশুদের স্বাস্থ্যের পক্ষেও দারুণ ক্ষতিকর। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন ডিজিটাল বা স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারের ফলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা শারীরিক, মানসিক, ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ডিভাইস ব্যবহারের ফলে মূলত শিশুরা দুই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ডিভাইস গুলোর বিভিন্ন ক্ষতিকর রশ্মি যেমন তাদের অসুস্থ করে তুলছে তেমনি অলস ভাবে এক জায়গা বসে থাকাও তাদের স্বাস্থ্যহানির কারণ।
ঢাকা শহরের বড় বড় হাসপাতাল গুলোতে খোজ নিয়ে জানা গেছে মাত্রাতিরিক্ত ডিভাইস ব্যবহারে ফলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধা গ্রস্ত হচ্ছে। আরও জানা গেছে ডিভাইস আসক্ত অধিকাংশ শিশুই পড়াশুনায় এবং সামাজিক মেলামেশায় পিছিয়ে পড়ছে।
তাছাড়া বেশিক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে শিশুদের চোখে দেখা দিচ্ছে নানা ধরণের সমস্যা। প্রভাব পড়ছে ব্রেনে এর ফলাফল, মাথা ব্যথা, মেজাজ খিটখিটে থাকা ইত্যাদি। প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির পক্ষেই ফোনের স্ক্রিন থেকে নির্গত রশ্মি যদি এত ক্ষতিকর হয় তাহলে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি কেমন হবে, একবার ভাবুন?
৩. সোশ্যাল মিডিয়ায় সাইবার বুলিং এর শিকার হচ্ছে শিশুরা
গবেষণায় দেখা গেছে মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ুয়া শিশুরা অনলাইন এবং সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে ব্যাপক ভাবে আগ্রহী আর এর ফলাফল হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভয়াবহ। অনলাইনে নিজেদের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করতে হয় না জেনে অনেক শিশুরাই শিকার হচ্ছে সাইবার বুলিং এবং পরিবারের কাছেও সেগুলো জানাতে পারছে না।
শিশুরা মাত্রাতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় এক্টিভ থাকাটা অনেক বাবা মা এর উদ্বেগে পরিণত হয়েছে। শিশুদের সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি নিয়ে একটি পত্রিকায় উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য, জানা গেছে গত বছরে ১৪৮জন শিশু আত্মহত্যা করেছে যার প্রধান কারণ ছিল সাইবার বুলিং এবং সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি।
আমরা যারা প্রাপ্ত বয়স্ক আছি তারা সবাই জানি অনলাইন ব্রাউজিং এর সময় আমরা কি কি ফেস করি। বিভিন্ন ধরণের ফিশিং, ভাইরাস, বিরক্তিকর এড, এডাল্ট কন্টেন্ট, ইত্যাদি থেকে আমরা নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারলেও শিশুরা সেটা কখনোই পারে না। ফলে যেকোনো ধরণের অবাঞ্ছিত কন্টেন্টে তারা মানসিক ভাবে ব্যাপক ধাক্কা খাচ্ছে।
২০০৫ সালের একটা গবেষণায় উঠে এসেছিল ৭০% এর বেশি ১৫-১৭ বছর বয়সী শিশুরা এক্সিডেন্টলি পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইটে ঢুকে যায়! ২০০৫ সালের রিপোর্ট এমন বললে বর্তমানে কি অবস্থা হতে পারে একবার কল্পনা করুন। শিশুরা ইন্টারনেটে কোন কিছু সার্চ করলে, পর্যাপ্ত মনিটরিং এবং ফিল্টারিং এর অভাবে এমন বিষয় গুলোর সাথে পরিচিত হচ্ছে যার জন্য সে প্রস্তুত নয়।
৪. স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারে দেখা দিচ্ছে স্লিপিং প্রবলেম
বিভিন্ন গবেষণা বলছে মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ডিভাইস, যেমন, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ব্যবহারের ফলে শিশুদের ঘুম কমে যাচ্ছে। গবেষকরা বলছেন ব্যবহার না করলেও শিশুদের বেডরুমে ফোন থাকা উচিৎ নয় কারণ এতে তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
আমরা সবাই হয়তো মানবজীবনে ঘুমের গুরুত্ব জানি।ঘুমের সময়, মস্তিষ্ক কিছু জরুরি কাজ করে যেমন, যে বিষয় গুলো গুরুত্বপূর্ণ নয় সেগুলো মস্তিষ্ক থেকে মুছে দেয়, স্নায়ু নেটওয়ার্ক পুনরুদ্ধার করে এবং পরবর্তী দিনের জন্য প্রস্তুত হয়৷ সুতরাং কম ঘুমানোর মানে হল যে আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে তার প্রয়োজনীয় চাহিদা থেকে বঞ্চিত করছি এবং দিনের বেলায় নিজের সৃজনশীলতা বিকাশে বাধা দিচ্ছি।
স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহারে ঘুম কমে যাচ্ছে শিশুদের এবং এতে করে দেখা দিচ্ছে শারীরিক নানা সমস্যা, পাশাপাশি সৃজনশীল ভাবে চিন্তা করতে পারছে না।
৫. বাবা মা এর সাথে শিশুদের সম্পর্কের অবনতি
একবার ভেবে দেখুন দিনে কত বার আপনি ফোনের নোটিফিকেশন চেক করছেন? আপনি যখন আপনার বাচ্চাদের সাথে ছিলেন তখন আপনি কতবার হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রাম খুলেছেন? সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ গুলো বোরিং সময় কাটানোর জন্য দারুণ হলে শিশুদের সামনে এগুলো ব্যবহার করার সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।
University of Michigan Health System দ্বারা প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, “ছোট বাচ্চাদের আশেপাশে মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার পিতামাতার অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব এবং তাদের বাচ্চাদের সাথে নেতিবাচক মিথস্ক্রিয়া ঘটাতে পারে। তাছাড়া Dr. Jenny Radesky বলেছেন, ” শিশুরা যা দেখবে তাই শিখবে”। অর্থাৎ আপনাকে সে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেখলে তারাও এটা ব্যবহার করতে চাইবে।
শিশুদের মাত্রাতিরিক্ত ডিভাইস ব্যবহারের তাদের একধরণের আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে ফলে বাবা-মা চাইলেও তার কাছে থেকে ডিভাইস গুলো নিতে পারছে না। জোর করে ডিভাইস নিয়ে যাওয়াতে সন্তান এবং বাবা মায়ের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
শেষ কথা
মোট কথা শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার পাশাপাশি আপনাকে অবশ্যই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার নিয়ে সচেতন হতে হবে। প্রযুক্তি নির্ভর এই যুগে পুরোপুরি ভাবে ডিজিটাল ডিভাইস বাদ না দেয়া গেলেও যথাযথ নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক দিক নির্দেশনাই পারে আপনার শিশুকে এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাঁচাতে।
এই আর্টিকেলে ডিজিটাল ডিভাইসের ক্ষতিকর দিক গুলো নিয়ে কথা বলা হল, পরবর্তী আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করেছি “কিভাবে স্মার্ট ডিভাইসের ক্ষতি থেকে রক্ষা করবেন আপনার শিশুকে” চাইলে দেখে নিতে পারেন।