শিশুদের ইন্টারনেট আসক্তি এবং এর ক্ষতিকর দিক
প্রযুক্তির এই যুগে সকল বয়সী মানুষ আজ ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত৷ প্রয়োজনীয় কাজে হোক, অলস সময়ে বিনোদনের মাধ্যম হোক, আমরা সবাই ইন্টারনেট ব্যবহার করছি। বড়দের পাশাপাশি ছোট শিশুরাও ইন্টারনেটের সাথে সমান ভাবে যুক্ত। অনলাইনে পড়া শুনা, ভিডিও কলে ক্লাস, স্ট্যাডি ম্যাটারিয়াল অনলাইনে শেয়ার ইত্যাদি কারণে শিশুদেরও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হচ্ছে।
শিশুরা সব সময় যে পড়াশুনার কাজেই ইন্টারনেট ব্যবহার করছে এমনটি কিন্তু নয়, তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের বেশিরভাগ সময় কাটছে বিনোদনের মাধ্যমে। বাবা মায়ের মধ্যে সঠিক প্যারেন্টিং জ্ঞান না থাকায় শিশুদের শান্ত রাখতে ইউটিউব দিয়ে বসিয়ে রাখা, গেম খেলতে দেওয়া ইত্যাদি কারণে শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে।
অনিয়ন্ত্রিত এই ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলাফল কিন্তু ভয়াবহ। এভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারে সতর্ক না হওয়ায় শিশুদের ইন্টারনেট আসক্তি তৈরি হচ্ছে। আর এই ইন্টারনেট আসক্তির ফলে তারা শারীরিক এবং মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অনিদ্রার মত শারীরিক সমস্যা তো দেখা দিচ্ছেই সাথে সাথে কম বয়সে শিশুরা হয়ে পড়ছে দু:চিন্তাগ্রস্ত।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানার চেষ্টা করব ইন্টারনেট আসক্তির ফলে শিশুরা কি ধরণের সমস্যার মধ্য দিয়ে যাবে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব কেমন,
উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা
ইন্টারনেটে অধিক সময় ব্যয় করার ফলে শিশুরা আস্তে আস্তে বাস্তব জীবন থেকে সড়ে যায়। তারা প্রতিনিয়ত ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল হতে থাকে। হঠাৎ করে ইন্টারনেট এক্সেস না পেলে তাদের মধ্যে দেখা দেয় উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা। বাবা মা ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি খেয়াল করে যখন ডিভাইস তাদের থেকে নিয়ে নেয় বা ইন্টারনেট ব্যবহার লিমিট করে দেয় তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের বিষণ্ণতা কাজ করে। ফলাফল সরূপ তারা পড়াশুনায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলে।
অনিদ্রা
যেসব স্কুলগামী শিশুদের ফোন রয়েছে তাদের দিকে ঠিক মত খেয়াল না রাখলে, তাদের মধ্যে দেখা দিতে ঘুম স্বল্পতা ও অনিদ্রা। ঘুমানোর আগে তাদের সাথে ফোন থাকলে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে করতে ঘুমের সময় পাড় হয়ে যেতে পারে। আমরা সবাই জানি ইন্টারনেট ব্যবহারে কখন সময় চলে যায় সেটা কারো খেয়ালই থাকে না। আর এভাবে অনিয়মিত ঘুমের ফলে দীর্ঘমেয়াদি ঘুম স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে শিশু ক্লাসে থাকতে পারে অমনোযোগী এবং ব্যহত হতে পারে তার সৃজনশীলতার বিকাশ।
সামাজিক হওয়া থেকে বঞ্চিত
শিশুদের বয়সের সাথে সাথে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে। শিশুরা পরিবার এবং সমাজকে দেখে নতুন নতুন বিষয় শেখে। সমাজে কার সাথে কেমন আচরণ করতে হবে তারা সেটা শিখে যখন পরস্পর কাছে আসে। কিন্তু ডিজিটাল ডিভাইস এবং ইন্টারনেট এই সামাজিক বন্ধন অনেকটাই কমিয়ে দিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে একে অপরের সাথে কানেক্ট থাকলেও বাস্তবে একে অপরের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে সেটা বুঝতে পারছেন না।
পরিবারের সবাই এক সাথে বসা হচ্ছে না ফলে পারিবারিক সম্পর্ক মজবুত হতে পারছে না। সবাই এক সাথে বসলেও সবার হাতে ফোন একে অপরকে আলাদা রাখছে আর এসব দেখে শিশুরাও তা শিখছে।
মিথ্যা বলার অভ্যাস
ইন্টারনেট আসক্তির ফলে শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন খারাপ অভ্যাস তৈরি হচ্ছে, যেমন বাবা মা যখন তাদের ফোন বা ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে তখন অধিকাংশ সময় তারা সেটা লুকাচ্ছে, মিথ্যা কথা বলছে। আর এভাবে শিশুরা মিথ্যা বলা শিখছে যা পরবর্তী ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে৷
মুড চেঞ্জ
ইন্টারনেট আসক্তির ফলে শিশুদের মুড চেঞ্জ হচ্ছে অহেতুক কারণে। ফুরফুরে মেজাজ মুহূর্তেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ করেই তাদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। বিভিন্ন কারণেই এমনটি হতে পারে যেমন অনলাইনে গেমিং করার সময় হেরে যাওয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় কারো সাথে মনমালিন্য হওয়া, বুলিং এর শিকার হওয়া ইত্যাদি।
নিয়মতান্ত্রিক জীবনে ব্যাঘাত
শিশুরা যখন ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে যায় তখন তারা রুটিন মাফিক চলতে পারে না। রাতে দীর্ঘ সময় ইন্টারনেট ব্রাউজিং এর ফলে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়া, হোম ওয়ার্ক করার পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া। ইত্যাদি কারণে শিশুরা নিয়মতান্ত্রিক জীবন থেকে সড়ে যেতে থাকে।
ইন্টারনেট ব্রাউজিং, অনলাইন গেমিং, ইউটিউবিং ইত্যাদি কাজে তাদের অধিক সময় ব্যয় হচ্ছে, ফলে প্রকৃতপক্ষে তখন যা করার কথা সেটা করতে পারছে না।
সমাজে ইন্টারনেট আসক্তির খারাপ দিক
শিশুদের ইন্টারনেট আসক্তি নি:সন্দেহে সমাজের জন্য ক্ষতিকর। মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহার শিশুদের পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হতে দেয় না, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ব্যাহত হয়৷ শিশুরা ইন্টারনেটে হতে পারে বুলিং শিকার, পড়তে পারে বিভিন্ন অনলাইন ফাঁদে। আর এই সমস্ত ঘটনায় মানসিক ভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আপনার শিশু। তাছাড়া অনলাইন বিভিন্ন স্ক্যামের ফাঁদে পড়ে শিশুরা আপনাকে আর্থিক ভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
তো শিশুদের এই সমস্ত ক্ষতিকর দিক থেকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজে সচেতন হোন এবং শিশুকেও সচেতন করুন। অপ্রয়োজনে শিশু যেন ডিভাইস ব্যবহার করতে না পারে সে দিকে নজর রাখুন। প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ফিচারের মাধ্যমে ডিভাইসের ফাংশনালিটি লিমিট করে দিন। প্রয়োজনে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট ব্লক করে রাখুন।